Channel 24
আন্তর্জাতিক
A-AA+
উপমহাদেশে সংঘাত, কারণ দুই প্রতিপক্ষই চোখ খোলা রেখে সেই পথে এগিয়ে যায়
ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত : ১৭:২৪, ২৯ এপ্রিল ২০২৫ | আপডেট: ১৯:৩৮, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
বীরদর্পে যুদ্ধে জড়াতে চায় ভারত-পাকিস্তান, তবে গোপনে খোঁজে মধ্যস্থতাকারীX
উপমহাদেশে সংঘাত, কারণ দুই প্রতিপক্ষই চোখ খোলা রেখে সেই পথে এগিয়ে যায়।
পুলওয়ামার ছয় বছর পর, ভারত ও পাকিস্তান ফের সেই কাজটাই করছে যেটা তারা সবচেয়ে ভালো পারে —
‘যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে’ অবস্থান করা কিংবা ‘চোখে চোখ রেখে’ মুখোমুখি অবস্থানে থাকা, আপনি এসব ইচ্ছাকৃত সংঘাতকে যেভাবে বলতে পছন্দ করেন না কেন।
সাংবাদিক আরিফা নূর জানিয়েছেন, সংঘাতের আশঙ্কা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, কারণ উভয় পক্ষ একে অপরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে, কূটনৈতিক উপস্থিতি আরও কমিয়ে দিচ্ছে এবং ভিসা বাতিল করছে। এদিকে, সংঘর্ষ ও সেনা
চলাচলের খবর পাওয়া যাচ্ছে, আর সরকারের অধীনস্থ মূলধারার গণমাধ্যমগুলো চিৎকার-চেঁচামিচিতে মেতে উঠেছে, যেটাকে দুই সরকারই নিজেদের অধীনত মনে করে।
পাকিস্তানে এখন প্রশ্ন উঠছে, আবারও কি কোনো ছোটখাটো সংঘাত হবে, বিমানযুদ্ধ হবে বা আরও কিছু, যার পেছনে সেই চিরচেনা আতঙ্ক — যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ভারতে যেন দাবি তোলা হচ্ছে- পাকিস্তানকে একটি উচিৎ ‘শিক্ষা’ দেয়া দরকার।
সবকিছু দেখে প্রশ্ন জাগে, পুলওয়ামা থেকে আদৌ কিছু শিখেছে কি তারা? এক আদর্শিক পৃথিবীতে পুলওয়ামার ঘট্না দুই দেশকে বোঝানোর জন্য যথেষ্ট ছিল যে সীমিত
সংঘাত সহজেই বড় যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। সেই অস্থির দিনগুলোতে মনে হয়েছিল সত্যিই যেন এই বাস্তবতা তাদের বুঝে এসেছিল।
আরও পড়ুন : মানবজাতি কি সভ্য হচ্ছে নাকি বর্বরতার দিকে এগোচ্ছে
এই পারের আলোচনা আমাদের জানার জন্য যথেষ্ট ছিল যে বালাকোট হামলার পর পাল্টা আঘাত হানার সিদ্ধান্ত সহজ ছিল না, যদিও সামরিক বাহিনী তার জন্য প্রস্তুত ছিল। একটি প্রকৃত উদ্বেগ ছিল — যদি ব্যাপারটা বড়
কিছুতে গড়ায়, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে। এজন্যই সম্ভবত ইসলামাবাদ সরকার উত্তেজনা কমানোর উদ্দেশ্যে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দিয়েছিল।
ভারত সরকারও যে এই বিপদের ব্যাপারে সচেতন ছিল, তা বোঝা যায় সেই সময়কার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর প্রকাশিত তথ্যে — তিনি বলেছিলেন, একজন ভারতীয় কর্মকর্তা তাকে ফোন করে আশঙ্কা প্রকাশ
করেছিলেন পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে এবং তারপর মার্কিন হস্তক্ষেপেই তা ‘প্রশমিত’ হয়েছিল। আজও আশা করা যায় যে, যদি নতুন করে হামলা বা অনুপ্রবেশ শুরু হয়, তাহলে পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে আবারও কেউ এগিয়ে আসবে।
তবুও, পুলওয়ামায় দেখা গিয়েছিল যে, বিপদের আশঙ্কা জানা সত্ত্বেও উভয় পক্ষ নিজেরাই সংঘাতে পা বাড়িয়েছিল এবং তারপর অন্যদের দিকে তাকিয়ে ছিল — কেউ
(মধ্যস্থতাকারী) এসে যেন তাদের থামায়। বহু দশক ও যুদ্ধ পেরিয়ে এসেও কোনো পক্ষ এখন পর্যন্ত শিখতে পারেনি কীভাবে সংকট এড়াতে হয় বা সংকট প্রশমিত করতে হয়; এজন্যই তারা এখনো অন্যদের ফোন করে ডাকে আর বলে ‘আমাদের ফেরাও এই খাদের কিনার থেকে।’
Advertisement
আরও পড়ুন : সংঘাতময় পরিস্থিতিতে যুদ্ধ কি সমাধান নাকি দীর্ঘস্থায়ী সংকটের অশুভ যাত্রা
এই একই ধারা যদি আবার চলতে থাকে, তাহলে তা প্রমাণ করে, উপমহাদেশে সংঘাত ব্যবস্থাপনা কতটা কঠিন — বা অসম্ভব। এখানে সংঘাত হয় না ভুল বোঝাবুঝি বা অনিচ্ছাকৃত উত্তেজনা থেকে, বরং দুই প্রতিপক্ষ
ইচ্ছাকৃতভাবেই সংঘাতে জড়ায়। আমরা যেমন ভাবতাম, পারমাণবিক শক্তিধর দেশ বা প্রক্সি যুদ্ধ নাকি শান্তি বজায় রাখে — বাস্তবে তা আর কাজ করছে না; বরং এখন উল্টো ফল দিচ্ছে — কারণ দুই দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগ করছে।
এজন্যই সরাসরি যোগাযোগ কার্যকর না-ও হতে পারে — কারণ কেউই বিশ্বাস করে না যে অপর পক্ষ যুদ্ধ চায় না। এখন কেবল বাইরের কোনো হস্তক্ষেপই পরিস্থিতিকে ঠান্ডা করতে পারে।
ভারত-পাকিস্তান সংকটের দ্বিতীয় দিকটি হলো গণমাধ্যমের ভূমিকা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা আরও উন্মত্ত হয়ে উঠছে। দুই দেশের এই চরম মনোভাব শান্তিকামীদের জন্য কোনো জায়গা রাখে না — কেবল যুদ্ধের হাঁকডাক। এমন অবস্থায় বোঝা মুশকিল হয়ে যায় — আসলেই কী জনমত এমন, নাকি সরকার নিজেই এ ধরনের প্রচারণা চালাতে উৎসাহ দিচ্ছে?
পাকিস্তানে, সম্প্রতি এক মন্ত্রী পাকিস্তানি মিডিয়াকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, ‘অন্য পক্ষের প্রচার’ পরাজিত করায়। কিন্তু এ ধরনের আলোচনা কিংবা চাপ আস্তে আস্তে নিজস্ব গতি তৈরি করে, এবং তখন সরকারকেই
তার সৃষ্টি করা ‘কঠিন বক্তব্য’ বাস্তবায়নে বাধ্য হতে হয়। এখানেই ভুল বোঝাবুঝির জায়গা তৈরি হয় — কারণ তখন আর সাংবাদিকরা জানাতে পারে না সরকার আসলে কী ভাবছে বা কোন পথে হাঁটছে।
তার বদলে যা প্রচারিত বা ‘খবর’ হিসেবে আসছে, তা হলো যুদ্ধের সংকেত। শেষ পর্যন্ত এটি সরকারগুলোর জন্য বিকল্প পথ সংকুচিত করে দেয়। এখন ভারতে প্রত্যাশা
তৈরি হয়েছে যে, প্রতিটি ঘটনাই বালাকোটের চেয়েও বড় কিছুতে রূপ নেবে; এদিকে পাকিস্তানে প্রত্যাশা তৈরি হয়, প্রতিটি ভারতীয় হামলার জবাবে একটি বিমান ভূপাতিত হবে — বা তার চেয়েও বেশি কিছু।
একজন পাকিস্তানি এবং সাংবাদিক হিসেবে আরিফা নূরের আরেকটি উদ্বেগ হলো — ভারতের কিছু ইংরেজি মতামতধর্মী লেখার ভাষা। একটি লেখায় ১৯৪৭ সালের সৃষ্ট ‘কৃত্রিম রাষ্ট্র কাঠামো’র ‘চিরতরে বিলুপ্তি’র কথা
বলা হয়েছে এবং তার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে একটি ‘সম্প্রসারিত ভারতীয় রাষ্ট্রের সীমানা’র বিবরণ। আরেকটি লেখায় বলা হয়েছে, ভারতের মানসিকতা এখন ১৯৪৭-এর যুক্তি সম্পূর্ণ করা — বা সেটিকে বাতিল করা।
এর সঙ্গে যদি সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে চলমান বক্তৃতা জুড়ে দেয়া হয়, তাহলে মনে হয় যেন পাকিস্তানের অস্তিত্বই হুমকির মুখে — কারণ এই পানি তো দেশকে জীবিত
রাখে, তা যদি সরিয়ে নেয়া হয় তাহলে আর কী থাকে? এবং এই হুমকি আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বে অন্যান্য রাষ্ট্রও এমন যুদ্ধ শুরু করেছে যার লক্ষ্যই অপর পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা — যেমন ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
বিশ্বব্যবস্থা যেভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর যারা সেটি তৈরি করেছিল তারাও এখন তা ধরে রাখতে পারছে না, এখন সরকার ও জনগণ সহজেই নরম ভাষা, নমনীয় নীতি এমনকি চুক্তি ও সমঝোতা — সব ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারছে। সিন্ধুর পানি চুক্তিও এর একটি উদাহরণ।
এই মুহূর্তে পাকিস্তানে প্রশ্ন তোলা দরকার — যদি নয়াদিল্লি সত্যিই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে, তাহলে বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কী করতে পারবে? এবং তখন ইসলামাবাদের সামনে কী বিকল্প থাকবে? চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা যুদ্ধ ঘোষণা হবে — এই সতর্কবার্তা নিয়ে এখন শান্তভাবে ভাবা দরকার।