ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে গোপন কারাগার, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এল ভয়াল জীবনের না বলা কথা
ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে গোপন কারাগার, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এল ভয়াল জীবনের না বলা কথা X
গোপন কারাগারে দেয়াল ঘেরা তিনটি সরু কক্ষ। ছবি: বিবিসি
রাজধানী ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের খুব কাছেই একটি গোপন কারাগার, যার অস্তিত্ব এতদিন ছিল অজানা। এই কারাগারের খোঁজ মেলে একজন সাবেক বন্দীর স্মৃতির সূত্র ধরে, যিনি
সেখানে দীর্ঘ আট বছর ধরে বিনাবিচারে আটক ছিলেন। সংবাদমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুনভাবে সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ।
ঢাকার ব্যস্ততম জায়গাগুলোর একটিতে-হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায়-সেখানে ছিল একটি ভয়াবহ গোপন কারাগার, যা এতদিন ছিল সাধারণের অজানা, অদৃশ্য। বহু বছর ধরে বহু মানুষ
সেখানে বন্দী ছিলেন-কারো বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ ছিল না, কাউকে আদালতে তোলা হয়নি, আর কারও পরিবার জানত না স্বজনরা কোথায় আছেন, আদৌ বেঁচে আছেন কি না।
এই গোপন কারাগারের খোঁজ মেলে মীর আহমাদ বিন কাসেম নামের এক আইনজীবীর স্মৃতির সূত্র ধরে। তিনি ছিলেন যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে এবং তার আইনগত সহকারী। ২০১৬ সালে হঠাৎ করেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। এরপর দীর্ঘ আট
বছর তাকে আটকে রাখা হয় একটি অন্ধকার, জানালাহীন ঘরে, যেখানে দিনের আলো ঢোকে না। তিনি বলেন,‘আমি আসলে তখন জানতাম না সময় কিভাবে যাচ্ছে। বাইরের পৃথিবী আমার কাছে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।’
মীর আহমাদ বিন কাসেম।
মীর আহমাদ বিন কাসেম।
গ্রীষ্মের অসহনীয় গরমে হাওয়ার জন্য তিনি দরজার নিচের ফাঁকা জায়গায় মুখ রেখে বসে থাকতেন। তার ভাষায়, ‘আমি ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিলাম, হারিয়ে যাচ্ছিলাম, এটি শুধু মৃত্যু নয়, এর থেকেও ভয়াবহ কিছু ছিল।’
আরও পড়ুন : নিজ দেশের নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে অনঢ় কে এই দুঃসাহসী নারী
এটি ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত ছিল, যেখানে ক্যামেরা, মাইক্রোফোন ও স্পাই গ্লাস দিয়ে প্রতিটি কোণ পর্যবেক্ষণ করা হতো। একজন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, সেখানে প্রায় ৩০ জন বন্দী থাকতেন এবং সবাইকে চোখ বেঁধে রাখা হতো।
মীর আহমাদ ছাড়াও এসব কারাগারে আরও অনেক নির্দোষ নাগরিক ছিলেন। আতিকুর রহমান রাসেল, এক তরুণ প্রকৌশলী, ২০২৩ সালে পুরান ঢাকার এক মসজিদ থেকে অপহৃত হন। তার চোখও বেঁধে রাখা হয়, নাম বা পরিচয় বললেই মার খেতে হতো। তার ভাষায়, ‘তারা আমাকে বলে, তুমি একটা সংখ্যা মাত্র, নাম বলার দরকার নেই।’Live
Channel 24
জাতীয়
A-AA+
ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে গোপন কারাগার, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এল ভয়াল জীবনের না বলা কথা
চ্যানেল 24 ডেস্ক
প্রকাশিত : ১৯:৫২, ১৬ এপ্রিল ২০২৫ | আপডেট: ২০:৩৪, ১৬ এপ্রিল ২০২৫
ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে গোপন কারাগার, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এল ভয়াল জীবনের না বলা কথা X
গোপন কারাগারে দেয়াল ঘেরা তিনটি সরু কক্ষ। ছবি: বিবিসি
রাজধানী ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের খুব কাছেই একটি গোপন কারাগার, যার অস্তিত্ব এতদিন ছিল অজানা। এই কারাগারের খোঁজ মেলে একজন সাবেক বন্দীর স্মৃতির সূত্র ধরে, যিনি
সেখানে দীর্ঘ আট বছর ধরে বিনাবিচারে আটক ছিলেন। সংবাদমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুনভাবে সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ।
ঢাকার ব্যস্ততম জায়গাগুলোর একটিতে-হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায়-সেখানে ছিল একটি ভয়াবহ গোপন কারাগার, যা এতদিন ছিল সাধারণের অজানা, অদৃশ্য। বহু বছর ধরে বহু মানুষ
সেখানে বন্দী ছিলেন-কারো বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ ছিল না, কাউকে আদালতে তোলা হয়নি, আর কারও পরিবার জানত না স্বজনরা কোথায় আছেন, আদৌ বেঁচে আছেন কি না।
এই গোপন কারাগারের খোঁজ মেলে মীর আহমাদ বিন কাসেম নামের এক আইনজীবীর স্মৃতির সূত্র ধরে। তিনি ছিলেন যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে এবং তার আইনগত সহকারী। ২০১৬ সালে হঠাৎ করেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। এরপর দীর্ঘ আট বছর তাকে আটকে রাখা হয় একটি অন্ধকার,
জানালাহীন ঘরে, যেখানে দিনের আলো ঢোকে না। তিনি বলেন,‘আমি আসলে তখন জানতাম না সময় কিভাবে যাচ্ছে। বাইরের পৃথিবী আমার কাছে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।’
মীর আহমাদ বিন কাসেম।
মীর আহমাদ বিন কাসেম।
গ্রীষ্মের অসহনীয় গরমে হাওয়ার জন্য তিনি দরজার নিচের ফাঁকা জায়গায় মুখ রেখে বসে থাকতেন। তার ভাষায়, ‘আমি ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিলাম, হারিয়ে যাচ্ছিলাম, এটি শুধু মৃত্যু নয়, এর থেকেও ভয়াবহ কিছু ছিল।’
আরও পড়ুন : নিজ দেশের নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে অনঢ় কে এই দুঃসাহসী নারী
এটি ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত ছিল, যেখানে ক্যামেরা, মাইক্রোফোন ও স্পাই গ্লাস দিয়ে প্রতিটি কোণ পর্যবেক্ষণ করা হতো। একজন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, সেখানে প্রায় ৩০ জন বন্দী থাকতেন এবং সবাইকে চোখ বেঁধে রাখা হতো।
মীর আহমাদ ছাড়াও এসব কারাগারে আরও অনেক নির্দোষ নাগরিক ছিলেন। আতিকুর রহমান রাসেল, এক তরুণ প্রকৌশলী, ২০২৩ সালে পুরান ঢাকার এক মসজিদ থেকে অপহৃত হন। তার চোখও বেঁধে রাখা হয়, নাম বা পরিচয় বললেই মার খেতে হতো। তার ভাষায়, ‘তারা আমাকে বলে, তুমি একটা সংখ্যা মাত্র, নাম বলার দরকার নেই।’
Advertisement
ইট দিয়ে দেয়াল করে দেয়া হয়েছিল দরজার আকারের এই ফাঁকাটি।
ইট দিয়ে দেয়াল করে দেয়া হয়েছিল দরজার আকারের এই ফাঁকাটি।
তার বর্ণনায় দেখা যায়, তাকে দিনের পর দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, মারধর করা হয় এবং প্রতিদিন ভাবতেন আজ হয়তো তার শেষ দিন।
অন্যদিকে, ২৩ বছর বয়সী রহমতুল্লাহ নামে এক তরুণ বলেন, তাকে এত ছোট একটি কক্ষে রাখা হয়েছিল যে তিনি দাঁড়াতে পারতেন না। শোয়া তো দূরের কথা, বসতেও পারতেন না। টয়লেট বলতে ছিল একটি খোলা ড্রেন। তিনি বলেন,‘ওরা আমার জীবন থেকে একটা বছর কেড়ে নিয়েছে। আমি এখনো ঘুমের মধ্যে জেগে উঠি—চোখে কালো কাপড় বাঁধা সেই অন্ধকার স্মৃতি আমাকে তাড়া করে।’
এই জেলখানার অবস্থান ছিল ঢাকার সেনানিবাস এলাকার ঠিক গা ঘেঁষে, যেখানে একটি গোপন ভবনে এই কর্মকাণ্ড চলত। জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনের কাজ চালানো হতো রাষ্ট্রীয় শত্রু সন্দেহে, কিংবা কেবল ক্ষমতাসীন দলের বিরোধিতা করার জন্য।
২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এই গোপন জেল বন্ধ হয়ে যায় এবং বন্দীদের ধীরে ধীরে মুক্তি দেওয়া হয়। তার পরেই উঠে আসে এই ভয়ংকর বাস্তবতা। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সারা দেশে এমন প্রায় ৭০০টি গোপন সেল থাকতে পারে যেখানে একইভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। তদন্তকারীরা বলছেন, এসব কাজ সরাসরি প্রধানমন্ত্রী জানতেন কিনা, সেটিও এখন প্রশ্নের মুখে।
বর্তমান সরকার তাজুল ইসলাম এর নেতৃত্বে তদন্ত শুরু করেছে। তিনি জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ১২২টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, কিন্তু কাউকে এখনও বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।
ভুক্তভোগীরা চাচ্ছেন, রাষ্ট্র যেন এই অন্যায়ের বিচার করে এবং এমন ভয়ানক অমানবিক ঘটনা আর যেন না ঘটে। মীর আহমাদ বলেন,‘এটা কোনো রাজনৈতিক প্রতিশোধ নয়, এটা মানুষের অধিকার ও সম্মান ফিরে পাওয়ার লড়াই।’